আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী রাহ.

আকবর আলী রাহ. (ইমাম – দরগাহে শাহজালাল রাহ.)
اكبر على أمام درغاه شاه جلال رحمه الله

লিখেছেন: মাওলানা ফয়সল আহমদ জালালী

বৃহত্তর সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন হাফেজ মাওলানা আকবর আলী। হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহ’র মাকবারা সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী মসজিদের দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর অধিক কালের ইমাম ও খতীব ছিলেন তিনি। এই জন্য সিলেট অঞ্চলে ইমাম সাহেব হুজুর নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। ইখলাস, তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির কারণে তাহাঁকেআরিফ বিল্লাহ উপাধিতে অনেকে অভিহিত করিতেন। তিনি ছিলেন দেওবন্দী ধারার একজন মনীষা। জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল মাদরাসার প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁহার অমর কীর্তি।

জন্ম ও পরিচিতি:

আকবর আলীর জন্ম তারিখ সঠিক ভাবে সংরক্ষিত নাই। বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ১৯১৬ সালে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল। (পাসপোর্ট অনুযায়ী তাঁহার জন্ম সন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ) সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপারা ইউনিয়নস্থ মাটিজুরা গ্রামের টুকা (বর্তমান নাম ইসলাম নগর) মহল্লায় তাঁহার জন্ম।

তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার ধর্মভীরু পিতার নাম ছিল আব্বাস আলী, মাতার নাম জহুরা বিবি। মাত্র ছয়মাস বয়সে তিনি মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হইয়াছিলেন। তাই সেই শিশুকাল হইতেই তাঁহার দুঃখ-বঞ্চনার শুরু। স্নেহময়ী মাতার ইনতিকালের পর পিতৃস্নেহে ও মামা মন্তাজ আলীর তত্ত্বাবধানে তিনি লালিত পালিত হন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শৈশবকাল থেকেই ইসলামী অনুশাসনের প্রতি আকবর আলীর ব্যাপক আগ্রহ ছিল।

শিক্ষা জীবন:

আকবর আলীর শিক্ষাজীবনের শুরু হয় গ্রামের মসজিদের ‘সাবাহী’ মক্তব হইতে। ছয় বছর বয়সে তিনি স্থানীয় মাথিউরা মাদরাসায় ভর্তি হন। ইহার পর বাহাদুরপুর ওয়াহিদিয়া মাদরাসায় (অধুনা বিলুপ্ত) চার বৎসর অধ্যয়ন করেন। অতঃপর ১৯৩১ ঈসায়ী সালে তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হইয়া টানা সাত বৎসর কৃতিত্বের সহিত লেখাপড়া করেন।

সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ফাযিল পাস করিবার পর তাহার এখানকার দরদি উস্তায আল্লামা সহুল উসমানী রাহিমাহুল্লাহ’র সহযোগিতা ও পরামর্শে উচ্চতর ইলম অর্জনের জন্য দারুল উলূম দেওবন্দের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে মুরাদাবাদ রামপুরা মাদরাসায় ছয় মাস লেখাপড়া করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। এখানে তিনি চার বৎসর মতান্তরে দুই বৎসর কৃতিত্বের সহিত অধ্যয়ন করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে তাঁহার উসতাদগণের অন্যতম ছিলেন-

  • আল্লামা ইবরাহীম বালইয়াবী
  • শায়খুল আদব ই’যায আলী
  • মুফতিয়ে আ’জম মুহাম্মাদ শফী
  • শায়খুত তাফসীর ইদরীস কান্ধালবী প্রমুখ।

হিফজুল কুরআন:

আকবর আলী হর-হামেশা আল- কুরআনের প্রেমিক ছিলেন। হাফেজ হওয়ার জন্য তাঁহাকে পৃথকভাবে কোন সময় ব্যয় করিতে হয় নাই; বরং লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন তিনি আল- কুরআনের কিছু কিছু অংশ মুখস্ত করিয়া শোনাইতেন। এই ক্ষেত্রে হাফেজ মু’তাসিম বিল্লাহ তাঁহাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করিতেন। এই ভাবেই তিনি আল-কুরআনের হাফেজ হইয়া গিয়াছিলেন।

তিলাওয়াতের প্রতি যত্নবান:

ইমামতি কালে তাঁহাকে প্রত্যেক ওয়াক্তে নূতন নূতন আয়াত তিলাওয়াত করিতে শোনা যাইত। ফরয সালাত এবং অন্যান্য সকল নফল সালাত মিলাইয়া প্রতিদিন তিনি আল-কুরআনের এক মনজিল তিলাওয়াত করিবার চেষ্টা করিতেন। এই ভাবে প্রত্যেক সপ্তাহে তাঁহার এক খতম হইয়া যাইত। রামাদানুল মুবারকে প্রায় ৪৫ বছর শাহজালাল দরগাহ মসজিদে খতমে তারাবীহে একাই বিশ রাক’আত সালাতে ইমামতি করিয়া আল-কুরআন খতম করিয়াছিলেন। বার্ধক্যে উপনীত হইবার পর শেষ প্রায় দশ বছর মুসল্লিদের সুবিধার্থে মসজিদে ইশার সালাতে ইমামতির পর বাসায় চলিয়া যাইতেন। সেখানে তাঁহার একান্ত ভক্ত-অনুরক্ত লোকজন অংশগ্রহণ করিতেন। তাহাদের সহিত তিনি সালাতুত তারাবীহে একাই আল-কুরআন খতম করিতেন।

ইমামতি:

দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নকাল হইতেই আকবর আলীর ইমামতি শুরু। সেখানকার ঐতিহাসিক ছাত্তা মসজিদে তারাবীহের সালাতে তিনি ইমামতি করিয়াছিলেন। সেই থেকে তাঁহার ইমামতি জীবনের শুরু হয়। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মাওলানা আকবর আলী সিলেট দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহিমাহুল্লাহ জামে মসজিদে দীর্ঘকাল ইমামতি করেন। ১৯৪৭ ঈসায়ীতে পাকিস্তান বিভক্তির ৬ মাস পূর্বে সিলেট শহরের নয়াসড়কে মুসলিমলীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে দরগাহ মসজিদের ইমাম পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই সময় আল্লামা সহুল উসমানী রাহিমাহুল্লাহ’র প্রস্তাবে মাওলানা আকবর আলীর উপর দরগাহ মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৪৭ ঈসায়ী হতে ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত সুনাম, দক্ষতা ও সম্মানের সাথে দরগাহ মসজিদের খতিব ও ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। সব মিলাইয়া সুদীর্ঘ ৫৮ বছর ছিল তাঁহার ইমামতির জীবন।

দৈহিক কাঠামো:

মাওলানা আকবর আলী ছিলেন একদম হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। উচ্চতায় তিনি ছিলেন লম্বা প্রকৃতির। তবে অতি উচ্চ ছিলেন না। চেহারা ছিল গোলাকার। নাক ছিল খানিকটা গোলাকার। দাড়ি ছিল পাতলা। তাঁহার আকার-আকৃতি ও লেবাস-পোশাক সাক্ষ্য দিত যে, তিনি আপাদমস্তক একজন দুনিয়া ত্যাগী বুযুর্গ মানুষ।

কর্মজীবন:

মাওলানা আকবর আলী নিজ উপজেলার বিয়ানীবাজার মাদরাসায় শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এক বছর পর তিনি আছিরগঞ্জ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় যোগ দেন ও সেখানে ছয় মাস শিক্ষকতা করেন। দরগাহে হযরত শাহজালাল মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হইবার পর প্রথমদিকে তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায়ও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।

জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহে হযরত শাহজালাল এর সূচনা:

দরগাহে হযরত শাহজালাল জামে মসজিদে ইমামতি কালে তিনি দক্ষিণ দিকের মুফতি বাড়িতে লজিং থাকিতেন। সেখানে তিনি ছাত্রদের আল-কুরআন এবং প্রয়োজনীয় দ্বীনিয়াত শিক্ষা দিতেন। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে।

ইহা ছাড়াও ইমামতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নামাজের পর তিনি মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে আল-কুরআনের দরস দিতেন। এই দরসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এলাকার জনগণের অন্তরে দ্বীন শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

১৯৫৮ সালে মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রহ. সিলেট সফরকালে তাঁহার একান্ত ছাত্র মাওলানা আকবর আলীকে পরামর্শ দিলেন- এখানে তুমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা কর। ইমাম সাহেব স্থানীয় বিদআত, রুসুমাতের বিষয় সম্পর্কে শংকা প্রকাশ করিলে মুফতী সাহেব বলিলেন- তুমি শুরু করিয়া দাও, আল্লাহর সাহায্য আসিবে। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হইয়া তাঁহার অন্যান্য উস্তাদ ও মুরব্বীগণের পরামর্শে তিনি ২৭ জুমাদাল উলা ১৩৮১ হিজরী / ৭ই নভেম্বর ১৯৬১ ঈসায়ী সনে মাজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি মাদরাসা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ মাদরাসার নাম ছিল তালিমুল কুরআন দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ. মাদরাসা, সিলেট। বছর কয়েকের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠান প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করিয়া ১৯৭৪ ইংরেজী সনে দরসে নেজামীর সর্বোচ্চ জামাত তাকমীল ফিল হাদীস স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

১৯৭৫ সালে মাওলানা আতহার আলী রাহিমাহুল্লাহ কারাগার হইতে মুক্তি লাভের পর সিলেট আগমণ করেন। একই সময় দারুল দেওবন্দের মুহতামিম কারী তায়্যিব রাহিমাহুল্লাহও সিলেটে আসেন। তাঁহার মাধ্যমে দাওরায়ে হাদীসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তিনি হাদীসের সবকের উদ্বোধন করেন। কারী তায়্যিব রাহিমাহুল্লাহ’র পরামর্শক্রমে বিখ্যাত হাদীস “ইন্নামা আনা কাসিম” এর ভিত্তিতে তালিমুল কুরআন থেকে মাদরাসা কাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল নামকরণ করা হয়। ইহারও পরে ‘জামিআ’ শব্দ যোগ করা হয়।

দায়িত্ব সচেতন:

মাওলানা আকবর আলী ইমামতির দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে মাদরাসাও পরিচালনা করিতেন। ইমামতি যেইভাবে তিনি অত্যন্ত তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির মাধ্যমে পালন করিতেন মাদরাসা পরিচালনায় ছিলেন খুবই সচেতন। বাহ্যত তাহাকে সহজ-সরল মনে হইলেও কাজে-কর্মে ছিলেন খুবই সচেতন। তিনি তাঁহার দফতরে অবস্থান করিয়া ছাত্র, উস্তাদ ও কর্মচারি সকলের গতি-বিধি সুচারুরূপে পর্যবেক্ষণ করিতে পারিতেন। সকলকে যেমনি তিনি স্নেহ করিতেন তেমনি কোন অনিয়ম বরদাস্ত করিতেন না। নিম্নমান বা উচ্চমান শিক্ষক হউন আর কর্মচারী হউন, কাহারও কোন অনিয়মকে তিনি ছাড় দিতেন না। কোন অভিযোগ কাহারো বিরুদ্ধে আসিলে তাহাকে নোটিশ দিতেন, আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আসিয়াছে আপনি ‘বারাআত নামা’ বা নির্দোষ বলিয়া প্রমাণ করুন।

তাঁহার ইলমী ও আমলী মাকাম ছিল অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। আমানতদারী ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল প্রশ্নাতীত। এই কারণে বিদগ্ধ শিক্ষকমণ্ডলী ও কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের নিকট তাঁহার খুবই মূল্যায়ন ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন হইতে মৃত্যু অবধি জামিআর লাগাম খুবই শক্তহাতে ধরিয়াছিলেন। কোন দিকেই তাঁহার কোন গাফলতি বা সামান্যতম অবহেলা ছিল না।

বায়’আত:

মাওলানা আকবর আলী আধ্যাত্মিকতায় প্রথমে বায়আত ছিলেন আল্লামা সহুল উসমানী ভাগলপুরী রাহিমাহুল্লাহ’র নিকট। তাঁহার সার্বিক দিক নির্দেশনায় তখন মাওলানা আকবর আলী আত্মশুদ্ধিমূলক অজীফা আদায় করিতেন। তাঁহার সিলেট ত্যাগ এবং পরবর্তীতে ইনতিকাল হইলে ইমাম আকবর আলী দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম কারী তায়্যিব রাহিমাহুল্লাহ’র এর নিকট বায়’আত হইয়া তাঁহার নিকট হইতে খেলাফত লাভ করিয়াছিলেন। প্রথমে তিনি পত্রযোগে ক্বারী তায়্যিব রাহিমাহুল্লাহ’র নিকট বাইয়াত হইয়াছিলেন। পরবর্তীতে সরাসরি সাক্ষাত করিয়া বায়’আত নবায়ন করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই আধ্যাত্মিকতার খিরকায়ে খিলাফত লাভে ধন্য হইয়াছিলেন। উল্লেখ্য, আল্লামা ক্বারী তায়্যিব রাহিমাহুল্লাহ হাকীমুল উম্মাহ আশরাফ আলী থানবী রাহিমাহুল্লাহ’র খলীফা ছিলেন।

তাঁহার নিকট হইতে ইজাযত প্রাপ্ত যাহারা:

পীরে কামিল আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহিমাহুল্লাহ’র নিকট হইতে যাহারা খিলাফত লাভে ধন্য হইয়াছিলেন, তাঁহারা হইলেন-

  • মাওলানা আবদুল হান্নান, সাবেক মুহতামিম- দরগাহে হযরত শাহজালাল মাদ্রাসা।
  • বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা সালেহ আহমদ জকিগঞ্জী
  • মাওলানা খলীলুর রহমান
  • মাওলানা আবদুন নূর
  • অধ্যাপক বাহা উদ্দীন যাকারিয়া
  • শায়খুল হাদীস মাওলানা মাহমূদ হুসাইন
  • জনাব গোলাম মাওলা
  • হাজী তেরা মিয়া প্রমুখ।

শেষের তিনজন বিলাত প্রবাসী।

মণীষীদের চোখে ইমাম আকবর আলী: দেশ-বিদেশের পীর ও মাশাইখে কিরাম সিলেট আসিলে ইমাম আকবর আলীর সহিত সাক্ষাত করিতেন। তাঁহার জবান সব সময় আল্লাহর যিকরে মশগুল রহিত। আল্লাহর মহিমা ও মহাত্মের কথা শুনিলে তাঁহার মুখ হইতে অগত্যা নিঃসৃত হইত ‘আহ’ ধ্বনি। পাকিস্তানের হযরত হাকীম আখতার রাহিমাহুল্লাহ ইমাম সাহেবের এই ধ্বনিকে ناله قلندر (আল্লাহ-প্রেমিকের বিলাপ) বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। মুহিয়ুস সুন্নাহ আবরারুল হক রাহিমাহুল্লাহ একদা সিলেটে আসিয়া বলিলেন-

“میں صرف اکبر علی کا الله آواز سننے کیلئے آیا ہوں”

(আমি শুধু আকবর আলীর আল্লাহ ধ্বনি শ্রবণ করিবার জন্য আসিয়াছি।)

দারুল উলূম দেওবন্দ (ওয়াকফ) এর মুহতামিম আল্লামা সালিম কাসিমী বলেন- “আকবর আলী তালিবুল ইলম যুগ হইতেই অধ্যয়নের সহিত আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করা শুরু করিয়াছিলেন”। মুফতী তকী উসমানী বলেন- “মাওলানা আকবর আলী সেই সকল বুজুর্গদের অন্যতম যাহারা ব্যবহারে অমায়িক, আল্লাহপ্রেমে বিলীন ও কলুষমুক্ত”। মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহি উদ্দীন খান বলেন- “মাওলানা আকবর আলী আমাদের মহান আসলাফের যেন জীবন্ত প্রতিচ্ছবি”।

বিদেশ সফর:

ইমাম আকবর আলী আন্তর্জাতিক মানের একজন বুযুর্গ হিসাবে পরিগণিত ছিলেন। বৃটেনে ছিল তাঁহার অসংখ্য মুরীদ ও ভক্ত-অনুরক্ত। এই জন্য তাঁহাকে বহুবার সেইখানে সফর করিতে হইয়াছিল। ইহা ছাড়া তাঁহার হজ্জের সফর যে কতবার হইয়াছিল, তাহার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াও কঠিন। ভক্ত অনুরক্তগণ তাঁহাকে দিয়া হজ্জ করানোর জন্য তাঁহার নোটবুকে সিরিয়াল দিয়া নাম লেখাইয়া রাখিতেন।

দাম্পত্যজীবন ও সন্তান-সন্ততি:

মাওলানা আকবর আলী ১৯৪৭ সালে দরগাহ মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। দীর্ঘকাল তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁহার প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত কোন সন্তান ছিল না। প্রথম স্ত্রীর ইনতিকালের পর আনুমানিক ১৯৯৫ সনে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর গর্ভজাত একমাত্র কন্যা সন্তান ছিল তাঁহার। উত্তরসুরি হিসাবে মারইয়াম নামের এই কন্যা সন্তানকে তিনি রাখিয়া গিয়াছেন।

স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য:

অধ্যক্ষ মাওলানা আকবর আলী ছিলেন অমায়িক আচরণের মানুষ সেই সাথে বিনয়ী, দানশীল ও অমুখাপেক্ষী। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ছিল তাঁহার একমাত্র পাথেয়। কোন কিছু প্রাপ্তির আশা ছিল না তাঁহার। এইজন্য প্রভাবশালীদের খেয়াল-খুশির তিনি তোয়াক্কা করিতেন না। অগণিত উলামায়ে কিরামের উস্তাদ ছিলেন তিনি। একেবারে পাশের লোক ব্যতীত অন্যদেরকে চিনিতেন না। সাক্ষাত করিতে আসিয়া পরিচয় দিলে খুশি মনে স্বাগত জানাইতেন। আগুন্তুকদের হাদিয়া দিতেন। ছাত্রদের ব্যাপারে তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল- তাহারা আমাদের কাছে আমানত। আমানত রক্ষার দায়িত্বে যেন আমরা অবহেলা না করি। অন্যথায় আল্লাহর আদালতে আমাদের জওয়াবদিহি করিতে হইবে। কোন ছাত্র বাড়িতে যাওয়ার ছুটি চাহিতে আসিলে ছুটির কারণ জিজ্ঞাসা করিতেন। কারণটি যথাযথ বিবেচিত না হইলে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বারবার বলিতেন- “বাড়ি তো কিতা হইছে, ভাই”।  সিলেটের বন্দর বাজার হইল শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। কেহ বন্দর বাজার যাওয়ার ছুটি চাহিতে আসিলে বলিতেন- “বন্দর তো কিতা হইছে, ভাই”। কোন ওয়াজ -মাহফিলে অংশগ্রহণ করিলে হাদিয়া গ্রহণ করিতেন না; বরং চাদা দিয়া আসিতেন। কাহারও বাসায় দা’ওয়াতে গেলে ফিরার সময় ভাড়ার কথা বলিয়া যেই হাদিয়া দেওয়া হইত তাহা রিক্সাওয়ালাকে দিয়া দিতেন। রিক্সাওয়ালা অবাক হইয়া তাঁহার দিকে তাকাইলে বলিতেন- এক বাসায় দা’ওয়াত খাইতে গিয়াছিলাম, তাহারা ভাড়া হিসাবে উহা দিয়াছিল। তাহা তুমি লইয়া যাও।

সালাতে কান্না:

ইমাম আকবর আলীর তিলাওয়াতে সহিত প্রাণের সঞ্চার হইত। কিরাআতের সময় প্রায়ই কান্নার আওয়াজ ভাসিয়া আসিত। কবর, হাশর, জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা সম্বলিত আয়াত তিলাওয়াত কালে হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেন। ইহাতে মুক্তাদিগণের হৃদয়ও আন্দোলিত হইয়া উঠিত। তাঁহার উস্তাদ ও মুরশিদ আল্লামা সহুল উসমানী একদা বলেন- وہ ایک طرف سلام پہرانے کے بعد دوسری طرف سلام پہرانے سے پہلے پہلے اسکی نماز قبول ہوجاتی ہے

(সে একদিকে সালাম ফিরানোর পর অপর দিকে সালাম ফিরানোর পূর্বেই তাহার নামায কবুল হইয়া যায়।)

শেষ জীবনে তাঁহার তিলাওয়াত অনেকখানি অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল। শুধু কান্নার ধ্বনিটি শোনা যাইত। তবুও মুসাল্লীগণ তাঁহার ইমামতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিছু সমালোচক তাঁহার স্থলে অন্য ইমাম নিয়োগ করিবার চাহিলে সাধারণ মুসল্লীগণ ইহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলে সমালোচকরা পিছু হটিতে বাধ্য হইয়াছিল।

অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব:

মাওলানা আকবর আলী কোন রাজনৈতিক দলের সহিত জড়িত ছিলেন না। তাঁহার সময়ে ইসলামী রাজনীতির বহু উত্থান-পতন ঘটিয়াছে, ইহার কোনটিতে তিনি অংশগ্রহণ করেন নাই। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া কাসিমুল উলূমে রাজনৈতিক পরিচয়ে কোন ইসলামী ব্যক্তিত্বকে গ্রহণ করা হইত না। তাঁহার মাদরাসার কোন তালিবুল ইলমের প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না।

মুনায়েম খানের অভ্যর্থনায় অংশগ্রহণ না করা:

পাকিস্তান আমলে মুনায়েম খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতাধর গভর্নর। অত্যন্ত শক্ত হাতের প্রশাসন ছিল তখন। তাঁহার সিলেট আগমণকালে প্রশাসনের নির্দেশ ছিল বিমান বন্দরে সংশ্লিষ্ট সবাই উপস্থিত থাকিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা জানাইতে হইবে। গভর্নরের সফরসূচিতে শাহজালালের দরগাহ যিয়ারতের কথা উল্লেখ থাকায় ইমাম আকবর আলীকে প্রশাসনের পক্ষ হইতে বিমান বন্দরে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা হয়। সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন নাই। এই কারণে তাঁহার চাকুরিচ্যুত হওয়ার আশংকা ছিল। দুনিয়ার মোহমুক্ত যাহারা তাঁহারা এইসবের তোয়াক্কা করেন না। গভর্নর দরগাহে আসিবার পর তাঁহার কাছে বিমান বন্দরে উপস্থিত না থাকিবার কৈফিয়ত তলব করেন। তিনি বলিলেন, আমি এই ধরণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হইনা। গভর্নর যুক্তি দেখাইলেন, ‘উলুল আমর’ এর ইতা’আত করা তো আল্লাহর নির্দেশ। ইমাম সাহেব নির্ভীক কণ্ঠে বলিলেন, সেই ‘উলুল আমর’ এই যুগে নাই। গভর্নর যখন বুঝতে পারিলেন, এই ব্যক্তির ইহজগতের সহিত কোন সম্পর্ক নাই তখন তিনি মাদরাসার জন্য কিছু অর্থ প্রদান করিবার চাহিলেন। ইমাম সাহেব বলিলেন- ইহা কওমী মাদরাসা, ইহাতে সরকারী অনুদান গ্রহণ করা হয় না। আপনার ব্যক্তিগত তহবিল হইতে প্রদান করা হইলে গ্রহণ করিব। গভর্নর মহোদয় নীরবে তাঁহার পকেট হইতে তখন কিছু টাকা দান করিয়া প্রস্তান করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমন্ত্রণে অংশগ্রহণ না করা:

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁহার শাসনামলে একদা দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা মাশায়েখকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন। মাওলানা আকবর আলীও ইহাতে আমন্ত্রিত ছিলেন। তিনি তাহাতে অংশগ্রহণ করেন নাই। পরবর্তীকালে একবার হজ্বে যাওয়ার সময় ইমাম আকবর আলী ঢাকাতে আসিলে সিলেটের এক নেতা তাঁহাকে রাষ্ট্রপতির নিকট লইয়া আসেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া ইমাম সাহেবকে কিছু নসীহত করার কথা বলিলে, ইমাম সাহেব তাঁহাকে তাই করিলেন। তখন সিলেট শহরে নাচ-গানের আসর চলছিল। ইমাম সাহেব বলিলেন, আপনি নির্দেশ দিলে তো তাহা বন্ধ হইয়া যায়। রাষ্ট্রপতি বলিলেন, তাহা অবশ্যই বন্ধ হইবে। অতঃপর রাষ্ট্রপতি বলিলেন, আমার নিকট আপনার কিছু চাওয়ার আছে? ইমাম সাহেব বলিলেন, হ্যাঁ আছে। রাষ্ট্রপতি বলিলেন, নির্ধিদ্বায় আপনি বলতে পারেন। অতঃপর ইমাম সাহেব বলিলেন, আপনার কাছে আমার চাওয়া হল, আপনি পরিপূর্ণভাবে মুসলমান হইয়া যান। অবাক বিস্ময়ে রাষ্ট্রপতি বলিলেন, আমার জন্য দু’আ করুন, যাহাতে আমি ইসলামের উপর পরিপূর্ণভাবে চলিতে সক্ষম হই।

ইনতিকাল:

হযরত মাওলানা আকবর আলী ২০০৫ সালের ৮ই নভেম্বর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে (পিজি হাসপাতাল) ইনতিকাল করেন। পরদিন বাদ জোহর লাখো মানুষের উপস্থিতিতে তাঁহার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। স্থান সংকুলানের স্বার্থে সিলেট এমসি কলেজ মাঠে জানাযা সম্পন্ন হয়। ইহাতে ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররমের তৎকালিন খতীব মাওলানা উবায়দুল হক। মসজিদ ও মাদরাসা সংলগ্ন মাকবারায়ে হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামানীতে তাঁহাকে দাফন করা হয়।

গ্রন্থপঞ্জী:

১. জুনাইদ কিয়ামপুরী, আরিফ আকবর আলী রাহ. আরিফ বিল্লাহ প্রকাশনী, ২০১৪
২. ইসলাম টাইমস, ১৫ জুলাই ২০১৯
৩. মাসিক আল-কাউসার, বর্ষ ১০, সংখ্যা -৯, ২০১৪
৪. সাপ্তাহিক সম্ভাবনা, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯,

ফয়সল আহমদ জালালী

এই কন্টেন্ট শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *