নন্দিরফল গ্রামের মাওলানা ইবরাহীম আলী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ আলেম। ইসলামী শিক্ষার একজন সচেতন শিক্ষক । শিরক-বিদ’আত বিরোধী একজন সচেতন সমাজ সংস্কারক । সেই সাথে ছিলেন একজন বিজ্ঞ ইমাম। বিয়ানীবাজার,গোলাপগঞ্জ ও বড়লেখা উপজেলার জনগণের মাঝে ছিল তাঁর ব্যাপাক খ্যাতি। একজন গ্রহণযোগ্য আলেম হিসেবে তিনি ছিলেন সমাজে পরিচিত। ইসলামী শরীআর জটিল বিষয়ের সমাধানের জন্য মানুষ তাঁর দ্বারস্থ হতেন। মাওলানা ইবরাহীম আলী দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে বাড়ি ফেরার পর এলাকাবাসীর অনুরোধে বাহাদুরপুর জালালিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা দান কাজে অংশগ্রহণ করেন। এই মাদ্রাসা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে তাঁর বহু ত্যাগ জড়িয়ে আছে। এতে কিতাব বিভাগ চালু হয়েছিল তাঁর শিক্ষক নিযুক্তির মাধ্যমে। এর পূর্বে এটি ছিল মূলত একটি কারিয়ানা মাদ্রাসা। নাম ছিল বাহাদুরপুর দারুল কোরআন কারিয়ানা মাদ্রাসা। গজারাই গ্রামের তৎকালীন অধিবাসী কারী আবদুস সবুর ছিলেন এই কারিয়ানা মাদ্রাসার প্রথম শিক্ষক। এদিকে মাওলানা ইবরাহীম ছিলেন কিতাব বিভাগের প্রথম শিক্ষক। কারী আবদুস সবুর ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মাপের একজন কারী । সেই সাথে ছিলেন সুললিত কন্ঠের অধিকারী । সুস্থতার সাথে তাঁর দীর্ঘায়ূ কামনা করছি । কারী সাহেব বর্তমানে নিজ ভাই-বেরাদর সহ জুড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
পারিবারিক পরিচিতি
নন্দিরফল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ইবরাহীম আলীর জন্ম । তাঁর পিতার নাম তাফাজ্জুল আলী ।
ইবরাহীম আলীরা ছিলেন চার ভাই ও দুই বোন। ভাইদের মাঝে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাই ‘মাস্টার’ হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। তাঁর নাম ছিল আবদুন নূর ওরফে হামন মাস্টার। দ্বিতীয় ভাইয়ের নাম আবদুশ শহীদ ওরফে ছামন । তিনি নিজেদের জমির চাষাবাদ দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই ফখরুল ইসলাম যৌবন কালেই মারা যান । ইবরাহীম আলীর ভগ্নিপতি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ মাওলানা ক্বারী আবদুর রহীম মোল্লাগ্রামী । তাঁর হাত ধরেই ইবরাহীম আলী মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হন ।
এলাকার সচ্ছল পরিবার হিসেবে তাঁরা বিবেচিত হতেন।মহিষ দিয়ে এই পরিবারের লোকজন তাঁদের চাষ যোগ্য জমিতে হাল দিতেন। তখনকার সময় যাদের চাষাবাদের জমি বেশি হত তারা মহিষ পালতেন । আমাদের গ্রামে তখন হাতে গোনা তিন চারটি পরিবারের মহিষ পালনের সামর্থ ছিল। মাওলানা ইবরাহীম আলীর চাচা মুদরিস আলী এলাকার বিশিষ্ট মুরব্বী হিসেবে সমাদৃত। তাঁর শতবর্ষী সেই চাচা এখনও জীবিত আছেন।
শিক্ষা জীবন
ইবরাহীম আলী সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুবিখ্যাত ঢাকাদক্ষিন আরাবিয়া হুসাইনিয়া মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। এর পূর্বে তিনি তাঁর ভগ্নীপতি মাওলানা আবদুর রহীম মোল্লাগ্রামী রাহিমাহুল্লাহ’র এর সাথে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাধীন কোন এক মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। এর চেয়ে বেশি তাঁর শিক্ষা জীবন সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়নি ।
কর্মজীবন
মাওলানা ইবরাহীম আলীর কর্মজীবন শুরু হয় বাহাদুরপুর জালালিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতার মাধ্যমে। দীর্ঘকাল তিনি এই মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তবে বিভিন্ন কারণে কিছু দিন তিনি মাদ্রাসার বাহিরে ছিলেন। এলাকার নানা দলাদলিই ছিল এর প্রধান কারণ । সেই সাথে তিনি ইমামতিও করতেন। মাদ্রাসা ও মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত হওয়ার পর তিনি এই দুই প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নন্দিরফল গ্রামের বর্তমান মসজিদের পূর্বেকার মসজিদ ঘরটি (যা এখনও উত্তর দিকে বিদ্যমান রয়েছে) তাঁর ইমামতির আমলেই নির্মিত হয়েছিল। এর আগে এটি কাঠের নির্মিত একটি মসজিদ ছিল। বর্তমান মসজিদ ঘরটি যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে ছিল মসজিদের পুকুর। তখনকার সময় ওজু ইসতিনজার সুবিধার্থে মসজিদের সাথে পুকুর খনন ছিল অত্যাবশ্যক ।
বাহাদুরপুর জালালিয়া মাদ্রাসার নামকরণ
একেবারে সূচনালগ্নে মাদ্রাসার নাম ছিল বাহাদুরপুর দারুল কোরআন কারিয়ানা মাদ্রাসা। তখন কেবল আল-কুরআন সাহীহ-শুদ্ধ করে শেখার একটি মাদরাসা ছিল এটি । মাওলানা ইবরাহীম আলী ও মাওলানা মুজীবুল হক এই মাদরাসায় নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর সেখানে কিতাব পড়ানো শুরু হয়। সঙ্গত কারণেই মাদ্রাসার নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে । তখন মাওলানা ইবরাহীম আলী মাদ্রাসার নামের সাথে ‘দারুল উলূম’ শব্দটি যুক্ত করে বাহাদুরপুর দারুল উলূম মাদ্রাসা নামে নামকরণ করেন। এতে কারিয়ানা বিভাগের সমর্থকগণ আপত্তি উত্থাপন করেন। অবশেষে মীমাংসার জন্য বিশেষজ্ঞগণের দ্বারস্থ হতে হয়। পরিশেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দারুল কোরআন ও দারুল উলূম এই দুই শব্দ বাদ দিয়ে হযরত শাহ জালালের নামের সাথে সম্পৃক্ত করে মাদ্রাসাটির নাম হবে বাহাদুরপুর জালালিয়া মাদ্রাসা। সেই থেকে এই নামেই মাদ্রাসাটি পরিচিত হয়ে আসছে ।
সংসারের কর্তাব্যক্তি
ভাইবোনের সংসারে মাওলান ইবরাহীম কর্তা ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। সাংসারিক দায়িত্ব পালনের তাগিদে তিনি নিজ এলাকা ত্যাগ করা পসন্দ করতেন না। তাই বিরাট প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে তাঁর কাজ করার সুযোগ হয়নি। সংসার পরিচালনায় তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি । বর্তমানে তাঁর ছেলে, ভাতিজা ও ভাতিজীদের অনেকেই যুক্তরাজ্যের অধিবাসী । আবার কেউ কেউ মধ্য প্রাচ্যের কোন কোন দেশে চাকুরী করছেন। গ্রামের সচ্ছল পরিবার হিসেবে তারা বিবেচিত হয়ে থাকেন। মাওলানা ইবরাহীমের দূরদর্শী চিন্তা ও সফল পরিচালনার জন্য তা সম্ভব হয়েছে ।
নন্দিরফল জামে মসজিদের ইমাম
দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর এলাকার মানুষ তাঁকে অত্যন্ত সাদরে গ্রহণ করেন। নন্দিরফল গ্রামে তখন তিনি ছিলেন একমাত্র টাইটেল পাস আলেম। মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হবার পর গ্রামের মানুষ তাঁকে মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন। দীর্ঘ দিন এই মসজিদে ইমামতির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সাপ্তাহিক মুষ্টি চাউল উঠানোর প্রচলন করেন। এর পূর্বে ইমাম সাহেবের বেতন উঠানো হত মহল্লার ঘরে ঘরে গিয়ে । এতে ইমামের বেতন অনেক বকেয়া থাকত। মুষ্টি চাউল উঠানো একটি কার্যকর উদ্যোগ ছিল। তখন থেকে ইমামের বেতন নিয়ে কোন সমস্যা হত না। পরবর্তীতে গ্রামের জনগণের মাঝে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দলাদলির সূত্রপাত হয় । প্রধান ইস্যু ছিল মীলাদ ও কিয়াম। এসব ইসলামে নেই বলে তিনি তা করতেন না। অবশেষে তিনি ইমামতির দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
বাহাদুরপুর পুরান বাড়ি মসজিদের ইমাম
জমিদারী আমলে নির্মিত হয় বাহাদুরপুর পুরান বাড়ি জামে মসজিদ। মাওলানা শফীকুল হক চৌধুরী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা । এর পাশে ছিল অধুনা বিলুপ্ত বাহাদুরপুর ওয়াহিদিয়া মাদরাসা। নন্দিরফল মসজিদের ইমামতি ত্যাগ করার পর মাওলানা ইবরাহীম আলী এই মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই মসজিদ পরিচালনায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না । মাওলানা শফীকুল হক চৌধুরীর ভাতিজা আবদুল বাকী ওরফে ফারুক চৌধুরী সরাসরি এই মসজিদ পরিচালনা করতেন। অসুস্থ হবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব মাওলানা ইবরাহীম সুচারুরূপে পালন করে গেছেন।
তাঁর হাত ধরে আমার লেখাপড়া শুরু
আমার স্পষ্ট মনে আছে, একদা আমি মাগরিবের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। মাওলানা ইবরাহীম আলী আমাকে ডেকে বললেন, কোথায় পড় ? তাকিয়ে দেখি টগবগে সুদর্শন এক যুবক। আমি তখন এতই ছোট্ট ছিলাম তাঁকে চিনতে পারিনি। কারণ মাত্র দাওরা হাদীস পাস করে এলাকায় ফিরেছিলেন তিনি। উত্তরে বললাম ওয়াহিদিয়া মাদ্রাসায় পড়ি । তিনি বললেন, টিকর পাড়ায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগামী দিন থেকে ওখানে যাবে। বাবা মা আর দাদুর কাছে বিষয়টি বললে তাঁরা সম্মতি জ্ঞাপন করেন। উল্লেখ্য আমার দাদু ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহ্ ভীরু এক মহিলা। আমার উপর আমার মা বাবার দু’আ তো অবশ্যই ছিল। তারপরও বলতে দ্বিধা নেই, আমি হলাম আমার দাদুর দু’আর ফসল। অভিভাবকদের পরামর্শ ক্রমে ঠিকই পরবর্তী দিন থেকে বাহাদুরপুর মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করি।
দৈহিক আকৃতি
অত্যন্ত সুদর্শন এক মানুষ ছিলেন মাওলানা ইবরাহীম। দৈহিক দিক দিয়ে খানিকটা বেটে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। গায়ের রঙ ছিল লাল মিশ্রিত সাদা । নাক ছিল ধারালো । গাল ভরা দাড়ি ছিল না তাঁর। সামান্য কিছু দাড়ি ছিল থুতনিতে । ফলে মুখমণ্ডলে সৌন্দর্যের আভা ফুটে উঠত। সুস্থ সবল কান্তিময় এক পুরুষ ছিলেন তিনি । বেটে প্রকৃতির হলেও ইবরাহীম আলী মুটো ছিলেন না। তাঁর বুক আর পেট ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
মধুর কন্ঠের অধিকারী
মাওলানা ইবরাহীম আলী ছিলেন অত্যন্ত মধুর কন্ঠের অধিকারী । দাওরায়ে হাদীস পাস করে এলাকাতে আসার পর তাঁর খুবই সমাদর ছিল। তাঁর সুমধুর তিলাওয়াতে মানব হৃদয় আকৃষ্ট হত। তিনি কোন সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন না । তবে মাঝে মধ্যে সুললিত কন্ঠে ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করতেন।
আফগানিস্তানের গজনী এলাকার প্রসিদ্ধ ফার্সি কবি সানায়ী (জন্ম ১০৮০ মৃত্যু ১১৩১) এর নিম্নোক্ত গজলটি তিনি আবৃত্তি করলে শ্রোতাদের হৃদয় শীতল হয়ে যেত। তিনি ফার্সি ভাষায় ছিলেন খুব দক্ষ। আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা মূলক এই গজল পরিবেশনের সময় তাঁর অশ্রু সিক্ত হয়ে যেত।
ملكا ذكر تو گویم كه تو پاكی و خدایی
نروم جز به همان ره كه توام راه نمائی
ہمہ درگاه تو جویم ہمہ از فضل تو پویم
ہمه توحید تو گویم كہ بتوحید سزائی
تو حکیمی تو عظیمی تو کریمی
تو نمایندہ فضلی تو سزاوار ثنائی
نتوان وصف تو گفتن كه در فهم نگنجی
نتوان شبه تو گفتن كه تو در وهم نیایی
تو زن و جفت نداری، تو خور و خفت نداری
احد بے زن و جفتی، ملكا كامروایی
نه نیازت به ولادت، نه به فرزندت حاجت
تو جلیل الجبروتی تونصیر الامرایی
بری از رنج و گدازی بری از درد ونیازی
بری از بیم و امیدی، بری از چون و چرائی
بری از خوردن و خفتن،بری از شرك و شبیهی
بری از صورت و رنگی بری از عیب و خطائی
نبُد این خلق و تو بودی نبود خلق و تو باشی
نه بجنبی نه بگردی نه بكاهی نه فزایی
همه عزی و جلالی همه علم و یقینی
همه نوری و سروری، همه جودی و جزایی
همه غیبی تو بدانی همه عیبی تو بپوشی
همه بیشی تو بكاهی همه كمّی تو فزایی
احدٌ لیس كمثله صمدٌ لیس له ضدّ
لِمَنْ المُلك تو گویی كه مرآن را تو سزایی
لب و دندان سنائی همه توحید تو گوید
مگر از آتش دوزخ بودش روی رهایی
ওয়াজ নসীহত
তিনি পেশাদার বক্তা ছিলেন না। ওয়াজ ও বক্তৃতার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বলে মনে হত না। তবে প্রয়োজনের মুহুর্তে ওয়াজ নসীহত হতে পিছপা হতেন না । আল-কুরআন ও আস-সুন্নাহ ভিত্তিক ছিল তাঁর আলোচনা। রঙ-রস ও কৌতুক পূর্ণ কথা তিনি এড়িয়ে চলতেন। শেষ জীবনে ওয়াজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হতেন।
ভুল ভ্রান্তির সংস্কারক
ইসলামী সংগীতের নামে অনেকে অর্থহীন বা শিরক বিদআত মিশ্রিত গজল উপস্থাপন করে থাকেন। ভাষা জ্ঞান না থাকার ফলে কেউ কেউ আরবী, ফারসি ও উর্দু গজল পরিবেশনে ভুল করে থাকেন। মাওলানা ইবরাহীমের ইলমী গভীরতা এই পরিমাণ ছিল যে, তাঁর কাছে এই ধরনের ভ্রান্তি ধরা পড়া যেত । সম্ভব হলে তিনি মজলিসেই তা সংশোধন করে দিতেন।
তাকওয়া ও আল্লাহভীতি
মাওলানা ইবরাহীম আলীর আল্লাহ ভীতি ছিল অনুকরনীয় । জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা শুনলে তাঁর চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরত। তিনি নিজে যখন পরকালে মহান আল্লাহর মার্জনা লাভ ও মাগফিরাতের ঘোষণা মূলক আয়াত তিলাওয়াত করতেন তখন আবেগ আপ্লুত হয়ে যেতেন। জাহান্নামের শাস্তির আলোচনা শুনে তাঁকে শিশুর মত কান্না করতে দেখা গেছে । হাদীসে এসেছে, আল্লাহর ভয়ে যেই চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না। অন্য এক হাদীসে এসেছে , নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ কালে যার চোখ অশ্রু সজল হয় কিয়ামত দিবসে সেই ব্যক্তি আল্লাহর আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে ।
তাকওয়া
অন্যায় অনাচার ও পাপ কর্ম থেকে বেঁচে থাকার নাম তাকওয়া। নৈতিকতা বিরোধী কাজ কর্ম থেকে যিনি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন তিনি হলেন মুত্তাকী । মাওলানা ইবরাহীম আলীর তাকওয়া ছিল প্রশ্নাতীত। সকল ধরনের অপকর্ম কে তিনি ঘৃণা করতেন। নৈতিকতা বিরোধী কাজে যারা লিপ্ত থাকত তাদের তিনি এড়িয়ে চলতেন। ইসলামের নামে কৌশল অবলম্বনে অর্থ উপার্জন করা ব্যক্তির ধারে কাছে তিনি যেতেন না । বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনে মসজিদ ও মাদরাসার নামে চাঁদা করা ছিল তাঁর স্বভাব বিরোধী। একারণে দায়িত্বশীলদের অনেক কটু কথা তাঁকে হজম করতে হত।
পরিবারের কাণ্ডারী
ভাইদের মাঝে তিনি তৃতীয় হলেও তাঁর সময় কালে যৌথ পরিবারের কাণ্ডারী ছিলেন তিনিই । বাবা মাও তাঁকেই পরিবারের কর্তা ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। কৃষিজ জমি ছিল তাঁদের অনেক। কৃষিজমি চাষাবাদ ছিল তাঁদের পরিবারের ব্যয় নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। তিনি ছাড়া সংসারে আর কেউ তেমন রোজগার ছিল না। বড় ভাইকে কুয়েত পাঠিয়েও আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়নি । ভাতের সংস্থান থাকলেও এত বড় পরিবারের অন্যান্য খাতের ব্যয়ভার বহনের কোন উৎস ছিল না। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ভাতিজা ভাতিজীদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। এজন্য খুব হিসেব নিকেশ করে জীবন যাপন করতে দেখা যেত তাঁকে ।
সুখের জীবনের সূচনা লগ্নে অসুস্থ
মাওলানা ইবরাহীম আলীর বড় ভাতিজির বিয়ে হয় স্পেন প্রবাসী এক পাত্রের সাথে । কিছুদিনের ভিতরেই ভাতিজির স্পেন যাওয়ার কাগজ পত্র চলে আসে। তখনকার সময়ে স্পেনের ভিসা সংগ্রহ করতে হত দিল্লী থেকে । আদরের ভাতিজিকে ভিসা আনার জন্য দিল্লী পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি । অতঃপর তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। অনেকের ধারনা বড় ভাতিজীকে এভাবে দিল্লী পাঠানোর মনো বেদনার ফলে তাঁর এই স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া।
সেই থেকে তাঁর স্বাভাবিক চলা ফেরা ও জবান বন্ধ হয়ে যায় । অতঃপর তাঁর একাধিক ভাতিজা ও ছেলে স্পেনে যাত্রা করেন। সংসারে সচ্ছলতা আসে তবে তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন নি। বর্তমানে তাঁর এক ছেলে ও একাধিক ভাতিজা/ভাতিজি ব্রিটেনে বসবাস করছেন।
ভাষা জ্ঞান
মাওলানা ইবরাহীম ছিলেন আরবী ভাষার একজন পণ্ডিত ব্যক্তি । আরবী ভাষার সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয় তিনি বিশ্লেষণ করতে পারতেন। এই কারণে আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের পুঙ্খানুপুঙ্খু অনুবাদ ও তাফসীরে তিনি ললছিলেন খুবই দক্ষ। এছাড়া উর্দূ ও ফার্সি ভাষাতেও তাঁর অগাধ বিচরণ ছিল। মাতৃভাষা বাংলাতেও তাঁর প্রচুর দক্ষতা ছিল। বাংলাতে কোন কিছু লিখলে তাঁর বানানে ভুল কম হত ।
জন্ম
মাওলানা ইবরাহীম আলীর সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায়নি । অনুমানিক ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৬০ সালে তাঁর জন্ম হয় ।
মৃত্যু
দীর্ঘ দিন রোগ ভোগের পর ৫ই মে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। হে আল্লাহ ! তোমার প্রেমে ফানা ফিল্লাহ তোমার এই প্রিয় বান্দাকে তুমি মাফ করে দিয়ে তাঁকে তোমার জান্নাতের স্থায়ী অধিবাসী কর।
ফয়সল আহমদ জালালী
দারুল উলূম নিউইয়র্ক
২৯/৯/২০২
এই কন্টেন্ট শেয়ার করুন: