“আমার সোনার বাংলা” রচনার প্রেক্ষাপট ও জাতীয় সংগীত হিসেবে বিরোধিতা কেন করবেন?

‘আমার সোনার বাংলা’ রচনার প্রেক্ষাপট: খ্যাতিমান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভেঙে দেওয়ার ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ‘বঙ্গমাতা’ সম্পর্কে এই গানটি লিখেছিলেন। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান “আমি কোথায় পাব তারে” থেকে এই গানের সুর ও সঙ্গীত উদ্ভূত।

সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিলো। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিলো।

প্রথমে জনপ্রিয় হলেও পরে ভারতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়।দুই.জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা”র পক্ষে যারা কথা বলেছেন, তাদের কাছে জানতে চাই (বিরোধীতা খাতিরে বিরোধীতা নয়) আপনারা যদি লেখা-পড়া করে থাকেন কিংবা সাহিত্য জগতের মানুষ হোন, তাহলে বলুন—একটি ‘গান বা ছড়া-কবিতা অথবা সংগীত’ রচয়িতার চিন্তা-চেতনা, উদ্দেশ্য বুঝতে পুরোটা পড়তে হবে না বিশেষ অংশ পড়েই সবকিছু উদ্ধার করা সম্ভব? যারা সাহিত্য জগতে আছেন সকলেই বলবেন পুরোটা পড়লে বা গাইলে লেখককে বোঝা সম্ভব। তাহলে নিজের বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করেন— ভিন্নধর্মী ও বিজাতীয় সংস্কৃতি লালনকারী একজন কবির ২৫ চরণের গান থেকে ১০ চরণকে বাংলাদেশের মতো ৯০ভাগ মুসলমানের দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করা কতবড় অন্যায় হয়েছে।

শুধু অন্যায় নয় বড়সড় একটা ষড়যন্ত্র! এবং বিশেষ কোনো দেশকে খুশি করতে স্বজাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।তাহলে কবি এবং বালাভাষার উপর নোবেল বিজয়ী হ‌ওয়ায় তাকে শ্রদ্ধা করা এককথা আর আমার দেশের জাতীয় সংগীত বানানো আরেক কথা।তিন.পূর্ণ গানটি হলো—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,মরি হায়, হায় রে—ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥

তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥

ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥

ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয় কীভাবে?
১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগ আয়োজিত এক জনসভায় গানটি গাওয়া হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে আওয়ামীলীগ মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এই গানটির প্রথম ১০ লাইন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে এর ৪.১ অনুচ্ছেদে “আমার সোনার বাংলা”র প্রথম ১০ চরণ (মোট ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গানের প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হ‌ওয়া নিয়ে বিরোধ ও বিতর্ক:

গানটি জাতীয় সংগীত হ‌ওয়া নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধ, সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে।

কারণ- ভাষা ও আঞ্চলিকতা।


ভারতীয় পটভূমি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতীয় এবং তাঁর রচিত গান ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জন গণ মন’-ও। এ কারণে বিদগ্ধজনেরা মনে করেন যে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত অন্য কোনো স্থানীয় কবি বা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কোনো একটিকে জাতীয় সংগীত করা উচিৎ।

২. যেহেতু এটি বঙ্গভঙ্গ-রদ প্রসঙ্গে লেখা এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা অস্বীকার করা হয়েছে বিধায় এটি
আঞ্চলিকতা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটির বদলে অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হওয়া উচিত।


৩. ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধাচরণ: ধর্মভীরু বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, গানটি ইসলামি চেতনার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ এটি দূর্গা-মা কে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, যা পুরো গানটি পড়লেই খুবই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। যেহেতু বাংলাদেশের মেজরিটি মুসলমান তাই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন একটি সংগীতকে জাতীয় সংগীত হিসেবে সাব্যস্ত করা হোক।

৪. রাজনৈতিক বিরোধ: রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিরোধ দেখা গিয়েছে, কারণ স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে ছাত্রলীগ-শ্রমীকলীগের অনুষ্ঠানে গানটি গাওয়া হয়েছে বলে পক্ষপাতদুষ্ট করতে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করার কারণ হতে পারে না।
রাজনৈতিক অনেক দল মনে করে যে বাংলাদেশের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে গানটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি।

৫. সাংস্কৃতিক বিরোধ: বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন মনে করেন,
বঙ্গভঙ্গ ও জাতীয়তাবাদ: “আমার সোনার বাংলা” গানটি বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়ায় এটি তখনকার পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবাংলা দুটিকে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হ‌ওয়ার উপযুক্ততা নেই এবং বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে না।
(চলবে)


মাওলানা শামসীর হারুন রশিদলেখক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

এই কন্টেন্ট শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *